IE and Textile | Textile Learning Blog

কে আমি ? - ইমরান হোসাইন - IE And Textiles

Breaking News

কে আমি ? - ইমরান হোসাইন

কে আমি - একটি ভৌতিক এবং আবেগঘন গল্প

কে আমি ?

শহরের শেষ প্রান্তে পুরনো একটা বাসা। বাসাটার পেছনে গভীর বনের মতো একটা জায়গা, যেখানে দিনের বেলাতেও আলো ঠিকঠাক পৌঁছায় না। সেই বাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে কেউ একজন তাকিয়ে থাকে। লোকমুখে শোনা যায়, সেখানে একজন একা থাকে, কিন্তু আসলে কে সেই একা মানুষ, তা কেউ জানে না।

আমার নাম ইমরান, সম্প্রতি শহরে নতুন এসেছি। কাজের সূত্রে অনেক দূর থেকে এই শহরে আসা। এই বাড়িটাতে আমি ভাড়া থাকি, আর সে বাড়ির পেছনেই সেই পুরনো, রহস্যময় ভুতুড়ে বাড়ি। প্রথমদিকে তেমন একটা ভয় পাইনি। শুনেছিলাম, কেউ নাকি রাতের অন্ধকারে দেখেছে সেখানে একটি সাদা ছায়া নীরবে হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু সেসব নিয়ে ভাববার মতো সময় আমার ছিল না।

এক রাতে, কাজ থেকে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। পুরো রাস্তা ফাঁকা, আমার চারপাশে যেন কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। বাসায় ঢুকে দেখলাম, সব লাইট অফ। হঠাৎ মনে হলো, জানালার বাইরে অন্ধকারের মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খুবই আবছা, যেন চোখের ভুল। কিন্তু পরদিন রাতেও একই অনুভূতি হলো। যেন কেউ আমাকে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

কিছুদিন এভাবে চলতে থাকলো। অস্বস্তিটা বেড়েই চলছিল। একদিন সাহস করে নিজেই গেলাম সেই পুরনো বাড়ির দিকে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটু থমকালাম। তখনই পেছন থেকে একটা কর্কশ কণ্ঠ শুনতে পেলাম, “কেন এসেছো?”

আশ্চর্যজনকভাবে, আমার ভয় লাগলো না। বরং মনে হলো, এই কণ্ঠটা যেন কোথাও শুনেছি। মনে হলো, যেন আমি এই কণ্ঠের সঙ্গে অনেক আগে পরিচিত ছিলাম। আমি সাহস করে বললাম, “তুমি কে? আমি তোমার কাছে কিসের জন্য এসেছি?”

অদৃশ্য সেই ছায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর বললো, “আমি কে? আমি তুমিই। সেই তুমি, যে একসময় সবকিছু ছেড়ে এখানে চলে এসেছিলে। যে নিজের অতীত ভুলতে চেয়েছিল। আমি তোমারই সেই অংশ, যে এখানে আটকে গেছে, বারবার তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায়।”

মুহূর্তেই আমার মনের মধ্যে ঝড় উঠল। বুঝতে পারলাম, এ আমারই এক রূপ। আমার অতীত, যা আমি ভুলে গিয়েছিলাম—সব কষ্ট, ব্যর্থতা, হারানো স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নেয়া এক ছায়া। সে আমার কাছে ফিরে এসেছে আমাকে আমার নিজের মুখোমুখি করাতে। আমি তাকে নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়, জানলাম, এতদিন আমি নিজের এই অংশকে অস্বীকার করেই এগিয়ে চলতে চেয়েছিলাম।

সেই রাতে প্রথমবারের মতো আমি গভীরভাবে নিজেকে মেনে নিলাম। অনুভব করলাম, আমার এই ছায়া আমার জীবনেরই অংশ। তারাও ছিল, আছে, থাকবে।

এরপর থেকে রাত নামলেই আমার কাছে যেন সেই ছায়া ফিরে আসে। কখনো কাছে এসে বসে, কখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে আমাকে দেখে। প্রতিবারই মনে হয়, সে যেন আমার একান্ত কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না। আমি বুঝতে পারি, সে আমারই হারানো এক অনুভূতি, ভুলে যাওয়া স্মৃতির একটা অংশ। যতই তাকে অস্বীকার করি, ততই সে আমাকে ঘিরে থাকে।

একদিন হঠাৎ একটা প্রশ্ন মাথায় এলো—আমি যদি এই ছায়ার সব কথা শুনতে পারি, তবে কি সে আমাকে ছেড়ে যাবে? আবার একা থাকতে পারব? নাকি ওটাই আসলে আমার আসল ভয়, যে আমি নিজের কষ্টের অংশটা একদিন সত্যিই হারিয়ে ফেলতে চাই না?

আমি ঠিক করলাম, এবার ওর গল্প শোনার চেষ্টা করব। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে, আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই ছায়া দেখা দিল। বললাম, “তুমি যা বলতে চাও, বলো। এবার আমি শুনব।”

ছায়াটা একটু নড়ল, আর কণ্ঠে খুব হালকা স্বরে বলল, “আমাকে ছেড়ে যেতে চেয়েছো বহুবার, কিন্তু তুমি বুঝতে পারো না, আমি তোমারই অংশ। আমাকে মেনে নাও, আর কষ্টটা তোমার নয়, এটা আমাদের।”

একটা অবিশ্বাস্য প্রশান্তি অনুভব করলাম। মনে হলো, অনেকদিন ধরে লুকিয়ে রাখা একটা ভার যেন কাঁধ থেকে সরে গেছে। আমি বললাম, “আমাকে আর কিছু বোঝাতে হবে না। তুমি আমার সাথেই থাকবে, কোনো কষ্টের মধ্যে নয়—একসঙ্গে।”

এরপর থেকে আমার ভয়টা আস্তে আস্তে কমে এলো। ছায়াটাকে আমি আর কখনও বিরক্তি বা বোঝা মনে করিনি। বরং, যখনই একা লাগত, মনে হতো সেই ছায়াটা আমার পাশে আছে। সে আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে, জীবনের প্রতিটা ব্যর্থতা, প্রতিটা হারানো স্বপ্নই আমাদের ভেতরে একটা ছাপ ফেলে।

একদিন, শেষবারের মতো সেই ছায়া আবার এলো, খুব শান্ত আর নিবিড়ভাবে। সে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এইবার তার মুখে যেন হাসি ফুটেছিল। আমি জানতাম, সে বিদায় নিতে এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখন নিজেকে পুরোপুরি বুঝতে শিখেছো। এবার আমি যাচ্ছি, কিন্তু তোমার ভেতরেই আছি, সবসময়।”

অদ্ভুত এক শান্তি নিয়ে আমি জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছায়াটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার রেখে যাওয়া প্রশান্তি আমার ভেতরে অমলিন হয়ে রইল। সেই রাতে প্রথমবার আমার ঘুম হলো কোনো স্বপ্ন ছাড়া—শান্ত, গভীর। যেন জীবনের ভার হালকা হয়ে গেছে।

এভাবেই আমার কল্পনার ছায়া মিশে গেল আমার জীবনের সঙ্গে, আর আমি হয়ে উঠলাম সম্পূর্ণ—এক সত্তার প্রতিচ্ছবি, যাকে বুঝতে পেরে আমি অবশেষে মুক্ত।

Author Picture
Imran Hosain
Senior Blogger

No comments